||কনক কুমার পাল (অলক)||
করোনায় গৃহবন্দী থাকতে থাকতে একটু হাওয়া বদলের খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ফেসবুক জুড়ে দেখতে পাচ্ছিলাম, মানুষ দলবেঁধে কেউ সাজেকে, কেউবা আবার সমুদ্রের জলে অথবা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে ছুটছে। এত দীর্ঘ সময় এর আগে কখনোই গৃহবন্দী থাকি নি। কিন্তু যাব কোথায়? পর্যটনকেন্দ্র গুলিতে যেভাবে মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করছি তাতে নিশ্চিতকরেই তা যথেষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলবে আর বেড়াতে গিয়ে ভিড় এড়ানো না গেলে বেড়ানোর আনন্দটাই ম্লান হয়ে যায়।
পয়লা অঘ্রাণ নবান্ন আয়োজনে আমন্ত্রণ পেলাম শ্বশুড়বাড়িতে যাবার। বন্ধুদের শ্বশুরবাড়ির গল্প শুনি, দুপুরে শ্বাশুড়ির রান্না খেয়ে রাতে এসে মা’র হাতের রান্না খায়। আমি অবশ্য সেই সৌভাগ্য বঞ্চিত। দক্ষিণের সীমান্তবর্তী, নিরিবিলি শহর চুয়াডাঙ্গায় বিয়ে করেছি। উত্তরের সাথে এই জেলাটির যোগাযোগ অনেকটা সৎ ভগ্নীর মত। সরাসরি কোন বাস যোগাযোগ নেই, সান্তাহার থেকে দিনে একটা ট্রেনই যায়। জনবহুল একটা দেশে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাবার জন্য সেই ট্রেনে যে পরিমাণ ভিড় হয় সে অভিজ্ঞতা হয়তো আপনাদের কিছুটা আছে। সিট পাওয়া অনেকটা লটারির ভাগ্য জেতার মতই। দিন দশেক আগেই মোবাইল এপ্স দিয়ে ট্রেনের টিকিট কেটে নিলাম।
তো যাই হোক, মনে মনে ঠিক করে ফেললাম এবার চুয়াডাঙ্গা গিয়ে পরেরদিন আরেক সীমান্ত শহর মেহেরপুর যাব সেখানে আমঝুপি নীলকুঠী আর মুজিবনগরের ঐতিহাসিক আম্রকানন দেখবো। মুজিবনগরে প্রায় এক যুগ আগে কলেজের শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম এখন এর অবয়বে অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে। মন স্থির করে যাত্রা শুরু করলাম ১৬ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার পথে।
ভ্রমণের কথায় এবারের পর্বে লিখবো আমঝুপি নীলকুঠি দেখার গল্প। বগুড়ার তুলনায় চুয়াডাঙ্গা বেশ শীতশীত ভাব অর্থাৎ শীত এখানে সমাগত। খুব সকালে ঘুমথেকে উঠতে ইচ্ছে না করলেও মনকে বোঝালাম এবার যদি আমঝুপি দেখতে না পারি তবে অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুদিন। এই সুজোগ তাই নষ্ট করা ঠিক হবে না। যাইহোক সকালে ঘি-ভাত নানা পদে মেখেচেখে খেয়ে শুরু করলাম যাত্রা।
চুয়াডাঙ্গা শহরের বুকচিড়ে চোলে গেছে পদ্মানদীর শাখা “মাথাভাঙ্গা” নদী। মাথাভাঙ্গা নদীর অপর প্রান্ত থেকে মেহেরপুর ডিলাক্স বাসে চড়লাম। বাস তখনো প্রায় খালি। বাইরে ঝকঝকে রোদ ঝলমল করছে। বাস হেল্পার বাসের গায়ে জোড়ে থাবা মেরে ক্রমাগত বোলে যাচ্ছে, চইলে আসেন, টাইম শেষ! মেহেরপুর! মেহেরপুর!! ৯.২০ মিনিটে হালকা চালে বাস ছাড়লো। জানালায় চোখ রাখলাম, বাস এগুতে থাকলো। শহর পেড়িয়ে গ্রামের ছোঁয়া পেতেই বদলে গেলো রূপ। মাঠজুড়ে চিকচিক করছে রবিশষ্যের সব কঁচিপাতা। শিশিরের ছোঁয়া পেয়ে আর তার সাথে রৌদ্রের আভা মিশে যেনো এক আনন্দ স্নানে মেতেছে কঁচি লালশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কলাপাতার দল। এই অঞ্চলে ধানের চেয়ে সবজির আবাদ বেশি হয়। আবার, চুয়াডাঙ্গার গুড়ের সুখ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। রাস্তার ধারে গাছিরা দেখলাম খেজুরগাছের বুকচিড়ে হাড়ি টাঙিয়ে দিচ্ছে। সারারাত ধরে টুপটুপ করে রস জমা হবে সেই পাত্রে সকালে গাছিরা এসে সংগ্রহ করবে সেই রস। আহ্! সকালের নরমরোদ আর সাথে খেজুরের রস আর মুড়ি বাঙালির চিরন্তন শীত রোমান্টিকতা। রোমান্টিক ভাবনায় ছেদ পড়লো কন্ট্রাকটরের ভাড়া চাওয়াতে।রাস্তার পাশের দোকানের সাইনবোর্ডে নাম দেখলাম বারদি অর্থাৎ বারদি থেকে আমঝুপি খুব বেশি দূরে না। কিন্তু এই রাস্তাটি আমার মনে ধরে গেলো। রাস্তার দু’ধারে শতশত আমগাছ যেনো অভিনন্দন জানাচ্ছে। আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম ফাল্গুন/ চৈত্র মাসে যখন আমের মুকুল আসবে তখন এই রাস্তার শোভা না জানি কি অসাধারণ হবে! মাথার চূড়ায় আমের মুকুট নিয়ে একেকটি গাছ হয়ে উঠবে রাজরানী সম। আমাদের জাতীয় সংগীতের সেই লাইনটি মনে পড়লো, ও মা ফাগুনে তোর আমের বনের ঘ্রাণে পাগল করে! বাস চলে এলো আমঝুপি। কন্ট্রাকটরের আবার বাসের গায়ে থাপ্পড়, ” আমঝুপি! পা চেইলে নেইমে আসেন।”
আমঝুপিতে নেমে একটা রিকসা ধরে চলে এলাম আমঝুপি নীলকুঠিতে। আড়ম্বরহীন এক শান্ত স্থাপনা প্রথমে এর কোন আলাদা রূপ মাধুর্য হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না কিন্তু কিছুসময় পর ভাললাগা শুরু হবে। তখন মনে হবে বাহ্! এ তো এক সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্য। আমাদের ইতিহাসের এক অমোঘ সত্য স্থাপনা। একবুক রোদন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই আমঝুপি নীলকুঠি। বেদনার রঙতো নীল তাই বুঝি আমঝুপি নীলকুঠির নামফলকটিও নীলরঙের ফলকে লিখা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাটির দায়িত্বে রয়েছে মাত্র কয়েকজন মানুষ। টিকিটঘরের দায়িত্বে থাকা লোকটির নাম এরশাদ। করোনায় পর্যটক একেবারে নেই বললেই চলে, এই আকালে আমাকে পেয়ে সেও যেনো এক নতুন বন্ধু পেলো। সেই আমাকে ঘুরিয়ে দেখালো সব।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পরে বঙ্গে কোম্পানি আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় বর্তমান মেহেরপুর সহ সমগ্র নদীয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনভুক্ত হয়। ব্রিটিশরা এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের স্থায়ী ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯ শতকের প্রথমভাগে মেহেরপুর অঞ্চলে স্থাপিত উল্লেখযোগ্য কাঠামোর অন্যতম হলো আমঝুপি নীলকুঠি। প্রায় ৭৪ একর জমির উপর ব্লুম নামের এক ইংরেজ ব্যক্তি কাজলানদীর তীরে এ কুঠি গড়ে তোলে। ইতিহাসের পালাবদলে এটি কখনো রাণী ভবানির জমিদারভুক্ত হয় এরপরে মথুরানাথ মুখার্জীর জমিদারভুক্ত হয় পরে তার ছেলে চন্দ্র মোহন বৃহৎ অর্থের টাকা নজরানা নিয়ে মেহেরপুরকে জেমস হিলের হাতে তুলে দেন।
এরশাদ ভাই আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন সব। শয়নকক্ষ, স্নেকপ্রুফ রুম যেখানে নাকি সাপ বা পিঁপড়া হাটতে পারে না এর মসৃনতলের কারণে। বিভিন্ন কক্ষের দেয়ালে টাঙানো আছ নানা ধরনের ছবি। নীল উৎপাদনের নানা চিত্র তুলে ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলেছেন যেনো প্রত্নতাত্ত্বিক কতৃপক্ষ । ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলের মাটি নীলচাষের জন্য খুব উপযোগী ছিল। কিন্তু নীলচাষে খুব লাভ না হওয়ায় কৃষকরা ধান ও পাট চাষের দিকে ঝুকে পড়ে কিন্তু ব্রিটিশ নীলকররা অত্যাচার ও নীপিড়নের মাধ্যমে কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করতো। নির্যাতিত নীলচাষীদের দুর্বার আন্দোলনে একদিন বাংলার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হলো নীলচাষ। প্যারী সুন্দরী নীল বিদ্রোহের এক অবিষ্মরনীয় চরিত্র। দেয়ালে টাঙানো প্যারী সুন্দরীর লড়াইয়ের কাহিনী পড়ে শিহরিত হয়ে উঠলাম। ইতিহাসের এই অগ্নিকন্যার নামটি আমি প্রথম জানলাম। এই রকম হাজারো লড়াইয়ের অগ্নিসাক্ষী হয়ে আছে আমাদের এই জনপদ। কত রক্তনদী পেরিয়েই না পেয়েছি স্বাধীনতা। কেউ মনে রাখে তাঁদের, কেউ রাখে না কিন্তু অর্জন ম্লান হয় না। কখনো কোন পর্যটক এমন অকুতোভয় সূর্যসন্তাদের সম্পর্কে জানতে পেরে অবনত মস্তকে প্রণাম জানায়।
জনশ্রুতি আছে রবার্ট ক্লাইভ প্রায়ই নাকি এই কুঠিতে আসতেন। এছাড়াও নীলকুঠিতে রয়েছে নাচঘর ও মৃত্যুকুপ। কিন্তু মৃত্যুকুঠিতে ঢুকে মন খারাপ হয়ে গেলো। এটি যদিও দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত নয়। কোন প্রজা খাজনা প্রদানে ব্যর্থ হোলে তাকে এই কুঠিতে এনে মৃত্যু নিশ্চিত করা হত। এই কুঠির ইট সুড়িকিতে কত কান্না যে মিশে আছে তা কল্পনা করে আর ভাল লাগলো না। দ্রুত চলে এলাম স্থাপনার পেছনদিকে একটা লম্বা মত বারান্দা আছে সেইখানে । রোদ পড়েছে বারান্দার রেলিং বরাবর। বারান্দার সন্নিকট থেকে সিড়ি নেমে গেছে কাজলানদীর ঘাটে। শীতে জুবুথুবু হয়ে আছে যেনো নদীর জল। সিড়িতে একজোড়া প্রেমিক বসে আছে। কিছুসময় পর প্রেমিক হাতে থাকা একটা স্থলপদ্ম গুঁজে দিল প্রেমিকার অলকখোঁপায়।
স্মৃতি ধরে রাখবার জন্য, ক্যমারায় অনেকগুলি ছবি নিলাম নীলকুঠির। এরশাদ ভাই আমার ছবিও কয়েকটি উঠিয়ে দিলেন। প্রায় তিনঘণ্টা কখন পাড় হয়েছে বুঝতেই পারি নি। সত্যি! ইতিহাস একটি জাতির জীবনের ধারাবাহিক চলচ্চিত্র এবং তাঁর সভ্যতার স্মারক।ইতিহাস তার গৌরব, কলঙ্ক, গর্ব আর দায়কে একসঙ্গে গেঁথে প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহন করে। সীমান্তশহর মেহেরপুরের এই পথে একদিন মোগল সেনাপতি মানসিংহের বিজয়রথ ছুটেছে, এই পথে ভাস্কর পন্ডিতের বর্গীদল ধুলি উড়িয়ে গেছে লুন্ঠনের কালো হাত বাড়িয়ে, বাংলা, বিহার,উড়িষ্যার অধিপতি নবাব আলীবর্দ্দী খাঁ মৃগয়ার স্মৃতিও রয়েছে এইখানে।
এমন একটি প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এসে দীর্ঘদিনের বন্ধজীবনের গুমোট মনের ভাবটা আর নেই। বাইরে অসংখ্য ঘুঘু আর বকের দল দেখলাম আপন খেলায় মেতেছে। ইচ্ছে থাকলেও এখানে আর বিলম্ব করা যাবে না কারণ আমঝুপি থেকে মেহেরপুর, মুজিবনগর প্রায় ঘন্টাখানিক পথ। ছুটতে হবে তাই। মুজিবনগরের গল্প না হয় অন্য আরেকদিন লিখবো। আজ এ পর্যন্তই। তবে শেষ করবার আগে আরেকবার বলে যাই, ইতিহাসের এই পথে পড়ুক আপনার ভ্রমণ পদযুগল । আপনার স্মৃতিতে জেগে উঠুক বা ধরা পড়ুক আমাদের ইতিহাসের বাঁক আর চলার পথ। কাজলা নদীর জলে জাগুক ঢেউ আর সেই ঢেউজলে মুখচ্ছবি খুঁজে পেলে আপনি পাবেন নির্মল আনন্দ। বাঁধাধরা জীবন থেকে কিছুটা সময় মুক্তির আস্বাদ।
কনক কুমার পাল (অলক) : শিক্ষক-সংস্কৃতিকর্মী paul.kanok@gmail.com